একটু কল্পনা করুন। আপনি রুটি বানাতে যাচ্ছেন। রেসিপি খুবই সহজ মনে হচ্ছে। আপনার সব উপকরণও একেবারে তাজা। আপনি প্রতিটি জিনিস নিখুঁতভাবে মেপে নিলেন। কিন্তু ওভেন থেকে যখন বের হলো, তখন সেটা পুরোপুরি ব্যর্থ। একেবারে ভেঙে পড়া ফলাফল। তাহলে আসলে কোথায় ভুল হলো?
ড. হানির বর্ণিত একটি গল্পে, ঠিক এই ঘটনাটিই ঘটে।
রেসিপিতে লেখা – আপনার লাগবে ৮৫০ গ্রাম ময়দা। সহজ ব্যাপার। আপনি ময়দা ঢাললেন একটি বড়, ভারি কাঁচের বাটিতে। তারপর সেটি রেখে দিলেন স্কেলের উপর। স্কেল দেখালো একেবারে ঠিক ৮৫০ গ্রাম। আপনি সব মিশিয়ে নিলেন, রুটি বেক করলেন, আর ফল হলো একেবারে শক্ত, অখাদ্য ইটের মতো কিছু।
সমস্যাটা কী হলো? প্রতিটি ধাপ তো একেবারে সঠিকই ছিল।
এখানেই ড. হানি একটি অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি দেন। তিনি বলেন:
“স্কেল সত্য বলছে, কিন্তু এটি সত্য নয়।”
একটু ভেবে দেখুন। স্কেল যখন ৮৫০ গ্রাম দেখালো, সেটি সঠিকভাবে কাজ করেছে। কিন্তু আমরা যে সত্য খুঁজছিলাম, সেটি ছিল না।
আসল সমস্যা কোথায়? সমস্যা কখনও ময়দায় ছিল না। উপাদান একেবারেই সঠিক ছিল। সমস্যাটি ছিল সেই ভারী কাঁচের বাটিতে, যেটির ভেতরে ময়দা ছিল। স্কেল একসাথে মেপে ফেলেছিল ময়দা + বাটির ওজন।
এখানে লুকানো অপরাধী হলো সেই কাঁচের বাটি। শুধু বাটির ওজনই ছিল বিশাল ৬২৬ গ্রাম।
মানে, আপনি ভেবেছিলেন ৮৫০ গ্রাম ময়দা আছে, কিন্তু আসলে ছিল মাত্র ২২৪ গ্রাম।
অবশ্যই রুটি ব্যর্থ হতো। কনটেইনার সম্পূর্ণভাবে মাপ নষ্ট করে দিয়েছিল।
সমাধানটা কী? সমাধান আসলে খুব সহজ। যেকোনো বেকার বলবে – প্রথমে খালি বাটি স্কেলের উপর রাখতে হয়, তারপর tear বা zero বাটনে চাপ দিতে হয়। তখন স্কেলকে বলা হয়: “এই বাটির ওজন বাদ দাও।” এর পরেই কেবল আপনি আসল উপকরণের নিখুঁত ওজন মাপতে পারবেন।
এই ছোট্ট কাজটাই হলো আসলে একটি মেথডোলজি।
ময়দা (flour): খাঁটি শাস্ত্রীয় টেক্সট (যেমন কোরআন)
কাঁচের বাটি (container): মানুষের ব্যাখ্যা ও ঐতিহ্য
tear করা (tare button): সঠিক পদ্ধতি বা মেথডোলজি, যা কনটেইনারকে বাদ দিয়ে আসল উপাদান আলাদা করে
মেথডোলজি হলো মানদণ্ড ও নির্দেশনার সেট, যা বলে দেয় একটি যন্ত্রকে সঠিকভাবে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে।
সেটা হতে পারে একটি কিচেন স্কেল
হতে পারে একটি মাইক্রোস্কোপ
কিংবা হতে পারে একটি পবিত্র গ্রন্থ
কিন্তু সঠিক মেথডোলজি ছাড়া, একটি যন্ত্র সত্য হলেও আপনাকে সম্পূর্ণ ভুল ফলাফল দিতে পারে।
কোরআনের মতো একক ও অনন্য টেক্সটের ক্ষেত্রে, আপনি বাইরে থেকে ধার করা কোনো মেথডোলজি ব্যবহার করতে পারবেন না। কিভাবে এটিকে পড়তে হবে, কিভাবে এর শব্দগুলো বোঝা হবে – সেই নির্দেশনা কোরআনের ভেতর থেকেই আসতে হবে। বাইরে থেকে কোনো কনটেইনার এনে টেক্সটের ভেতর কিছু চাপিয়ে দিলে হবে না।
ড. হানি একটি নাটকীয় উদাহরণ দেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বলা হয়, নবী নূহ বেঁচেছিলেন ৯৫০ বছর। এই সংখ্যা সর্বত্র পাওয়া যায়, প্রায় সব অনুবাদ ও ব্যাখ্যায়।
কিন্তু আসলেই এই সংখ্যা কোথা থেকে এলো?
ড. হানির মতে, এটি বাইরের একটি কনটেইনারের নিখুঁত উদাহরণ। গবেষকেরা ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে ৯৫০ বছরের ধারণাটি নিয়ে এসেছিলেন, তারপর সেটি কোরআনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেন। উপাদানের সাথে বাইরের কনটেইনার মিশে গিয়েছিল, অথচ কেউ টেরও পাননি।
কোরআনের ওই আয়াতে দুটি আলাদা আরবি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে:
সানা (sana)
আম (‘ām)
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এগুলোকে সমার্থক ধরা হয়েছে, দুটোই “বছর” মানে বলে। কিন্তু ড. হানির যুক্তি হলো – কোরআন এগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে।
সানা (sana): প্রায়ই দুর্দশা, অনুর্বরতা বা অকার্যকর অবস্থা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ, অকার্যকর মানুষ বা সময়।
আম (‘ām): উৎপাদনশীল সময় বা কার্যকর বছর।
এই পাঠ অনুযায়ী, আয়াত আসলে বলছে:
وَلَقَدْ اَرْسَلْنَا نُوْحًا اِلٰى قَوْمِهٖ فَلَبِثَ فِيْهِمْ اَلْفَ سَنَةٍ اِلَّا خَمْسِيْنَ عَامًا ۗفَاَخَذَهُمُ الطُّوْفَانُ وَهُمْ ظٰلِمُوْنَ
And we have sent Nuḥ to his community, and he remained among them – One thousand unproductive people except fifty (of them) – one year (or a period of time), and they were punished by the angels while they were transgressing,
আর আমরা নূহকে তার সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি, এবং সে তাদের মধ্যে অবস্থান করেছিল – এক হাজার অকার্যকর লোকের মধ্যে পঞ্চাশ জন ব্যতীত – এক বছর (অথবা একটি সময়কাল), এবং ফেরেশতারা তাদেরকে শাস্তি দিয়েছিল যখন তারা সীমালংঘন করছিল,
অতএব, তিনি তাদের সাথে ছিলেন মাত্র একটি আম – এক বছর।
অর্থাৎ, ৯৫০ বছর নয়, বরং মাত্র এক বছর।
এই একটিমাত্র ভাষাগত মেথডোলজির কারণে উপসংহার পুরোপুরি বদলে যায়। ৯৫০ বছর → এক বছর।
ড. হানির পুরো যুক্তি একটিমাত্র শক্তিশালী ধারণায় এসে মিশে যায়:
👉 কোনো মৌলিক টেক্সটকে সত্যিকারভাবে বুঝতে হলে, প্রথমেই প্রয়োজন একটি কঠোর মেথডোলজি, যা উপাদানকে (খাঁটি টেক্সট) আলাদা করে ফেলবে কনটেইনার থেকে (ব্যাখ্যা, ঐতিহ্য, বাইরের প্রভাব)।
অন্যভাবে বললে – আপনাকে স্কেলটা আগে tear করতে হবে, তারপরই মাপটা বিশ্বাসযোগ্য হবে।
এবং এখানেই আমাদের জন্য এক উস্কানিমূলক প্রশ্ন রয়ে যায়, যা কেবল কোরআন নয়, যেকোনো জ্ঞান শেখার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য:
👉 আমরা যা জানি, তার কতটুকু আসলেই খাঁটি সত্য, আর কতটুকু কেবল সেই কনটেইনারের ওজন, যেটি আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল?