বিস্ময়কর কোরআন

না! কুরআনের আবু লাহাব মুহাম্মদের চাচা নন!

যদি কুরআনের সবচেয়ে বিখ্যাত কাহিনীগুলোর একটি—একটি গল্প যা আপনি হয়তো শতবার শুনেছেন—আসলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুরোপুরি ভুলভাবে বোঝা হয়ে থাকে তাহলে কী হবে? আজ আমরা ঢুকছি কুরআনের সবচেয়ে ছোট এবং সত্যি বলতে সবচেয়ে বিখ্যাত সূরাগুলোর একটিতে—সূরা আল-মাসাদ। কিন্তু আজকের বড় প্রশ্নটা বেশ চমকপ্রদ। যদি এতদিন আমরা ভুল পরিচয়ের ফাঁদে আটকে থাকি?

ঠিক আছে, প্রথমেই আমরা দ্রুত দেখে নিই আবু লাহাবের গল্পটি, যা আমরা অনেকেই ছোটবেলায় শিখেছি।

প্রচলিত বর্ণনা
• আবু লাহাব ছিলেন নবী মুহাম্মদের চাচা।
• তিনি ছিলেন এক তিক্ত শত্রু, যিনি নবীকে হয়রানি করতেন।
• সূরা আল-মসাদে তার চিরন্তন ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।
• এই ভবিষ্যদ্বাণী তার মৃত্যুর ১০ বছর আগে এসেছে।
• তার স্ত্রী উম্মে জামীলকেও ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।

কিন্তু, এবং এটি একটি বড় “কিন্তু”—ড. হানি দেখান, যখন আপনি এই কাহিনীকে কুরআনের নিজস্ব বক্তব্যের সাথে তুলনা করেন, তখন কিছু গুরুতর ফাঁকফোকর চোখে পড়ে। এখানেই বিষয়টা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কারণ কুরআনের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ যুক্তির আলোকে দেখলে, এই প্রচলিত গল্পটি শুধু কিছু ফাটলই তৈরি করে না, বরং বিরাট ধর্মতাত্ত্বিক বৈপরীত্য তৈরি করে, যেগুলো আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না।

“How could Abu Lahab believe when part of that belief was that he cannot believe?”

“আবু লাহাব কীভাবে ঈমান আনতে পারত, যখন সেই ঈমানের অংশই ছিল যে সে ঈমান আনতে পারবে না?”

# আবু লাহাব কীভাবে এমন একটি কুরআনে বিশ্বাস করতে পারতেন, যেখানে ইতিমধ্যেই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে তিনি অবিশ্বাসী হিসেবেই মারা যাবেন? এটা তো এক যৌক্তিক স্ববিরোধিতা।
একবার ভেবে দেখুন। আল্লাহ কিভাবে আশা করতে পারেন যে আবু লাহাব কুরআনে বিশ্বাস করবে, যখন সেই একই কুরআন গ্যারান্টি দিচ্ছে যে সে কখনো ঈমান আনবে না? মানে, যদি সে কুরআনকে সত্য বলে মেনে নেয়, তাহলে তাকে একইসাথে এটাও মানতে হবে যে সে কখনো মুমিন হতে পারবে না। এ যেন এক নিখুঁত “ক্যাচ-২২”। [ক্যাচ-২২ (ইংরেজিCatch-22) হলো একপ্রকারের কূটাভাসিক পরিস্থিতি যেখানে বিপরীতধর্মী নিয়মনীতি ও সীমাবদ্ধতার জন্যে কোন ব্যক্তিবিশেষ এটাকে এড়াতে পারে না।]

# যদি তার পরিণতি মৃত্যুর ১০ বছর আগে-ই সীলমোহর করে দেওয়া হয়ে থাকে, তবে তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির কী হলো—যা ঈমানের একটি মূল ভিত্তি?
পুরো ব্যাপারটি সরাসরি আঘাত করছে ইসলামের মৌলিক ধারণা—স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি বা ফ্রি উইল-এর উপর। কুরআন তো বারবার বলছে যে মানুষকে বেছে নেবার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তাহলে, যখন বলা হলো আবু লাহাবের পরিণতি আগে থেকেই ঠিক করা, অথচ তার তখনও জীবনের প্রায় ১০ বছর বাকি—তাহলে তার পছন্দ বা স্বাধীনতা কোথায়?

# অন্যরা হত্যা ও নির্যাতনের মতো আরও ভয়াবহ অপরাধ করেছিল। তবে কেন শুধুমাত্র আবু লাহাবকে আলাদা করে শাস্তি দেওয়া জন্য বেছে নেওয়া হলো?
ঠিক আছে, সে নবীকে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু অন্যরা তো বিশ্বাসীদের নির্যাতন করেছে, হত্যা করেছে। তাহলে তার শাস্তি এত অদ্ভুতভাবে কঠিন হলো কেন? মনে হয় না এটা একটু বেমানান? ইতিহাস তো আমাদের বলে অনেকেই অনেক ভয়ংকর কাজ করেছে—নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা। কিন্তু আবু লাহাব ও তার স্ত্রীকেই নাম ধরে চিরন্তন অভিশাপ দেওয়া হলো কেন? প্রশ্ন জাগে—কেন শুধু তাদের?

এবং সম্ভবত সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—এটা কুরআনের অন্য অংশের সাথেই সাংঘর্ষিক। কুরআনের অন্য আয়াতে বলা হয়েছে—কেউই, এমনকি নবীও জানে না কার চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে। তাহলে দুটো কথা একইসাথে কিভাবে সত্য হতে পারে? স্পষ্টতই পারে না।

তাহলে এতগুলো বৈপরীত্য সামনে আসায় প্রশ্ন জাগে—হয়তো প্রচলিত গল্পটাই ভুল? এসব প্রশ্ন তো শক্তভাবে একটি নতুন ব্যাখ্যা দাবি করছে। আর ড. হানি একেবারেই ভিন্ন এক পরিচয় তুলে ধরেন আবু লাহাবের জন্য।

আবু লাহাব আদতে কোনো ব্যক্তি নামই নয়। এটা একটি উপাধি, একটি বর্ণনা। আবু মানে “পিতা” এবং লাহাব মানে “অগ্নিশিখা”। অর্থাৎ—“অগ্নিশিখার পিতা”। এটা সবচেয়ে বড় নির্যাতকের জন্য যথাযথ উপাধি—যে মানুষকে আগুন দিয়ে নির্যাতন করত—ফিরআউন

এতে পুরো বিষয়টাই বদলে যায়। হ্যাঁ —এটা নবীর ৭ম শতাব্দীর মক্কার চাচা নয়, বরং হাজার বছর আগের মূসার যুগের ফিরআউন। 

কিন্তু কিভাবে এই সিদ্ধান্তে আসা গেল? ড. হানি একেবারে শূন্য থেকে কিছু বানান না। তিনি চারটি নির্দিষ্ট “চাবি” দিয়ে প্রমাণ দাঁড় করান।

মূলনীতি হলো—কুরআনের কোনো রহস্য সমাধান করতে হলে শতাব্দী ধরে চলে আসা গল্পে ভরসা করলে হবে না। সমাধান অবশ্যই কুরআনের ভেতরেই থাকতে হবে। কুরআনকেই হতে হবে গাইড। আর প্রধান ফরেনসিক টুল হলো কুরআনিক মার্কারস—যা একধরনের ভাষাগত ফিঙ্গারপ্রিন্ট। কুরআন বিশেষ বিশেষ শব্দ বা বাক্যাংশ ব্যবহার করে আলাদা আলাদা সূরার মধ্যে সংযোগ ঘটায়, যেগুলো প্রথম দেখায় সম্পর্কহীন মনে হয়।

এবার চারটি প্রমাণ একে একে দেখা যাক:

প্রমাণ ১: ভাষাগত সূত্র
এখানে মূল ক্রিয়াপদ হলো তাব্বা—যার অর্থ ধ্বংস হওয়া বা কেটে যাওয়া। পুরো কুরআনে এই শব্দ মাত্র চারবার এসেছে। দুবার এসেছে আবু লাহাবের সূরায়, আর বাকি দুবার? হ্যাঁ, সরাসরি ফিরআউনের ব্যাপারে। নিছক কাকতালীয়?

প্রমাণ ২: ব্যাকরণগত সূত্র
সূরার সব ক্রিয়াপদ অতীত কালে। “সে কেটে ফেলেছিল”, “সে যা অর্জন করেছিল”—অতীতে ঘটেছে এমন ঘটনা। এটি পুরোপুরি মিলে যায় ফিরআউনের সাথে—যে অনেক আগেই ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু নবীর চাচা তো তখনও জীবিত ছিলেন আরও দশ বছর।

প্রমাণ ৩: বিষয়গত সূত্র
সূরায় বলা হয়েছে আবু লাহাব প্রবেশ করবে অগ্নিশিখার মধ্যে। কুরআনে খুঁজে দেখলে—যদি কোনো নির্দিষ্ট মানুষকে নাম ধরে জাহান্নামের আগুনের ওয়াদা করা হয়ে থাকে—সেটি কেবল একজনকেই, আর সে ফিরআউন।

প্রমাণ ৪: প্রাসঙ্গিক সূত্র
কুরআনে ফিরআউনের অপরাধ বলা হয়েছে—বিশ্বাসীদের আগুন দিয়ে নির্যাতন, তাদের হাত কেটে ফেলা। আর আবু লাহাবের শাস্তি হিসেবে সূরায় বলা হলো—আগুনে পোড়া এবং হাত কাটা। অপরাধ ও শাস্তির একেবারে আয়না-সদৃশ মিল।

তাহলে যদি আবু লাহাব আসলে ফিরআউন হন, তবে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু তখনই উঠে আসে আরেকটি প্রশ্ন—“তার স্ত্রী”—যাকে বলা হয়েছে “কাঠকুড়ানি বহনকারী”—তিনি কে?

এখানেই গল্পের সবচেয়ে চমকপ্রদ মোড়। কারণ ফিরআউনের স্ত্রীকে কুরআনে বলা হয়েছে একজন সৎ মুমিনা, যিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন ফিরআউনের অমঙ্গল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। তাহলে কীভাবে সূরায় তাকেও অভিশাপ দেওয়া হতে পারে? সেটা তো সম্ভব নয়।

তাহলে আমরা ভুলভাবে পড়ছি। ড. হানি দেখান—আরবী বাক্যাংশগুলো গভীর অর্থ বহন করে। হাম্মালাত আল-হাতাব শুধু “কাঠকুড়ানি বহনকারী” নয়—এটা মানে হতে পারে “যিনি বোঝা কাঁধে নিলেন, যিনি কেটে ফেলার আদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন”। আর হাবলুম-মিন-মাসাদ কেবল “খেজুর আঁশের দড়ি” নয়—এটা মানে হতে পারে “একটি শক্ত পাকানো অঙ্গীকার, একটি গোপন চুক্তি, গভীর প্রতিজ্ঞা”

এই অর্থগুলো আয়াতে বসালে পুরো চিত্রই উল্টে যায়। এটি আর শাস্তির বিবরণ নয়, বরং তার বীরত্বের ঘোষণা। তিনি সেই নারী, যিনি গোপন চুক্তি ও প্রতিজ্ঞা নিয়ে শিশুমূসাকে ফিরআউনের হত্যার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।

May the hands of Abu Lahab be cut off, and he did cut off (past tense)! (111:1)

আবু লাহাবের হাত কেটে ফেলা হোক, এবং সে তো কেটেই ফেলেছিলো (অতীত কালে)! (111:1)

Of no use to him were his wealth and what he gained (past tense), (111:2)

তার ধন-সম্পদ এবং যা কিছু সে অর্জন করেছিল—কোনোটিই তার কোনো উপকারে আসেনি, (111:2)

He shall be seared over a fire with flames, (111:3)

সে দগ্ধ হবে শিখাময় অগ্নিতে, (111:3)

And his subordinate woman, (was) the one who took the burden against the cutting (i.e., against killing Mussa), (111:4)

আর তার অধীনস্থ নারী, (ছিল) সেই যে বোঝা বহন করেছিল কেটে ফেলার (অর্থাৎ, মূসাকে হত্যা করার) বিরোধিতায়, (111:4)

In her neck (i.e., she took upon herself) an accord (an agreement) that is tight (because it is well twisted)! (111:5)

তার গলায় (অর্থাৎ, সে নিজের উপর গ্রহণ করেছিল) এক অঙ্গীকার—যা শক্ত, কারণ তা ভালোভাবে পাকানো! (111:5)

খন দুই ব্যাখ্যা পাশাপাশি রাখুন—
🔹 প্রচলিত ব্যাখ্যা: একটি পারিবারিক ঝগড়া, যা বিরাট ধর্মতাত্ত্বিক প্রশ্ন তৈরি করে।
🔹 ড. হানির ব্যাখ্যা: ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অত্যাচারী ফিরআউন, এবং সেই বীর নারী যিনি একজন নবীকে রক্ষা করেছিলেন।

এবং দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি শুরুতে উত্থাপিত প্রতিটি বৈপরীত্যের সমাধান দেয়।

তাহলে কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ? কারণ এভাবে পড়লে সূরা আল-মাসাদ একটি ছোট পারিবারিক কাহিনী থেকে রূপ নেয়—অত্যাচারের বিরুদ্ধে চিরন্তন শিক্ষা, অন্ধকারে লুকানো নীরব বীরত্বের কাহিনী, এবং ঈমান ও ন্যায়ের প্রকৃত অর্থের প্রকাশে।

সবশেষে, একটি চমকপ্রদ ভাবনা রয়ে যায়। যদি কেবল টেক্সট-ভিত্তিক ফরেনসিক বিশ্লেষণ কুরআনের সবচেয়ে বিখ্যাত সূরাগুলোর একটিকে পুরোপুরি নতুন আলোয় দেখাতে পারে, তাহলে প্রশ্ন জাগে—আর কত রহস্য এখনো আমাদের চোখের আড়ালে লুকিয়ে আছে?

নংসূরার নামমোট আয়াতঅনুবাদ করা হয়েছে
1আল- ফাতিহা77
2আল-বাকারা28664
3আল-ইমরান20056
4নিসা17632
5আল-মায়িদাহ12035
6আল-আনাম16535
7আল-আরাফ20662
8আল-আনফাল7511
9আত-তাওবাহ1298
10ইউনুস10925
11হুদ12325
12ইউসুফ111111
13আর-রাদ4310
14ইবরাহীম526
15আল-হিজর9918
16আন-নাহল12838
17বনি ইসরাইল11129
18আল-কাহফ11074
19মারিয়াম9853
20ত্বা হা13539
21আল-আম্বিয়া11239
22আল-হাজ্ব7811
23আল-মুমিনুন11832
24আন-নূর646
25আল-ফুরকান7744
26আশ-শুআরা22735
27আন-নমল9356
28আল-কাসাস8828
29আল-আনকাবুত6914
30আল-রুম6034
31লুকমান3424
32আস-সাজদাহ309
33আল-আহযাব7335
34আস-সাবা547
35আল-ফাতির4510
36ইয়া সিন8383
37আস-সাফফাত18252
38সোয়াদ8839
39আয-যুমার7533
40আল-মুমিন8520
41ফুসসিলাত5420
42আশ-শূরা539
43আয-যুখরুফ8935
44আদ-দুখান5919
45আল-জাসিয়াহ3712
46আল-আহকাফ3517
47মুহাম্মদ3813
48আল-ফাতহ299
49আল-হুজুরাত184
50ক্বাফ4524
51আয-যারিয়াত6017
52আত-তুর493
53আন-নাজম6262
54আল-ক্বমর5519
55আর-রাহমান7878
56আল-ওয়াকিয়াহ9696
57আল-হাদিদ297
58আল-মুজাদিলাহ222
59আল-হাশর243
60আল-মুমতাহানা132
61আস-সাফ146
62আল-জুমুআহ115
63আল-মুনাফিকুন111
64আত-তাগাবুন182
65আত-ত্বালাক121
66আত-তাহরীম126
67আল-মুলক308
68আল-ক্বলম528
69আল-হাক্ক্বাহ5219
70আল-মাআরিজ444
71নূহ286
72আল-জ্বিন2828
73মুযাম্মিল202
74মুদাসসির561
75আল-কিয়ামাহ4023
76আল-ইনসান3131
77আল-মুরসালাত5050
78আন-নাবা4040
79আন-নাযিয়াত463
80আবাসা4242
81আত-তাকবির2929
82আল-ইনফিতার1919
83আত-তাতফিক367
84আল-ইনশিকাক2525
85আল-বুরুজ222
86আত-তারিক1717
87আল-আলা190
88আল-গাশিয়াহ261
89আল-ফজর304
90আল-বালাদ207
91আশ-শামস1515
92আল-লাইল210
93আদ-দুহা111
94আল-ইনশিরাহ88
95আত-তীন81
96আল-আলাক1919
97আল-ক্বাদর55
98আল-বাইয়িনাহ83
99আল-যিলযাল88
100আল-আদিয়াত1111
101আল-কারিয়াহ110
102আত-তাকাছুর88
103আল-আসর30
104আল-হুমাযাহ99
105ফীল55
106আল-কুরাইশ41
107আল-মাউন70
108আল-কাওসার30
109আল-কাফিরুন60
110আন-নাসর30
111লাহাব55
112আল-ইখলাস40
113আল-ফালাক55
114আন-নাস66
  62362307