কিন্তু, কেউ কি এমন কিছুর প্রতি আত্মসমর্পণ করতে পারে যা সে নিজেই বোঝে না?
দ্বীন বোঝার প্রথম ধাপ হল—কুরআনের পরিভাষা বোঝা। কুরআনিক শব্দভাণ্ডারের সঠিক অনুধাবন ছাড়া আত্মসমর্পণ অগভীর রয়ে যায়—বা এমনকি ভ্রান্তির শিকারও হতে পারে।
শুধুমাত্র তখনই, যখন কেউ শব্দগুলো যেমন:
মুসলিম, মু’মিন, কাফির, মুনাফিক, দ্বীন, শিরক, তাকওয়া, সবর ইত্যাদি বুঝে ফেলে—তখনই সে বুঝতে পারে যে, আল্লাহ তার ওপর কী কী দায়িত্ব, ভূমিকা, নীতিমালা, কার্যপ্রক্রিয়া, অধিকার ও কর্তব্য আরোপ করেছেন।
একবার পরিভাষা বুঝে গেলে, তখন সেই ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত শাসন কাঠামোর ভিতরে থাকা নীতিমালা ও প্রত্যাশাগুলো চিনে নিতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে—
অন্যভাবে বললে: কেউ যদি পরিভাষা না বোঝে, তাহলে সে যদি মনে করে যে সে “মুসলিম” কী—তা জানে, তবে সে আসলে একটি স্বপ্নের ঘোরে আছে।
উদাহরণস্বরূপ,
“মুসলিম” আর “মু’মিন” এর মধ্যে পার্থক্য কী?
এই পার্থক্যটা অত্যন্ত মৌলিক—কিন্তু অনেকের কাছেই তা অস্পষ্ট, কারণ তারা পরিভাষাগত যথার্থতাকে গুরুত্ব দেয় না। কুরআনভিত্তিক বোঝাপড়া ছাড়া কেউ কখনোই সঠিকভাবে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করতে পারবে না—দ্বীনের শাসন কাঠামোর মধ্যে তার ভূমিকা আসলে কী, সেটা সে ধরতেই পারবে না।
একজন মুসলিম হল সেই ব্যক্তি, যিনি স্বেচ্ছায়, নিজের ইচ্ছায়, পূর্ণরূপে বুঝে ও গ্রহণ করে—এই দ্বীনের প্রতি এবং আল্লাহর নির্ধারিত শাসন কাঠামোর প্রতি আত্মসমর্পণ করেন।
এখানে মনে রাখতে হবে, “দ্বীন” শব্দটি বোঝায় এমন একটি সম্পূর্ণ কার্যকরী ব্যবস্থা—যার মধ্যে এই দুনিয়ার বাস্তব জগত তো রয়েছেই, পরকালও এর অন্তর্ভুক্ত। আমি আশা করি, এটি এখন পরিষ্কার।
সেই অনুযায়ী, শাসন কাঠামো বলতে বোঝানো হচ্ছে—নিয়ম, নীতিমালা, কার্যপ্রণালি, পরিভাষা, ভূমিকা, দায়িত্ব ইত্যাদি, যা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত এক প্রতিষ্ঠিত ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার অংশ।
তাহলে “মু’মিন” শব্দটি মুসলিমের তুলনায় কী আলাদা কিছু বোঝায়?
“মুসলিম” হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আত্মসমর্পণ করেছেন।
এখন একটা উদাহরণ ধরা যাক—ধরা যাক, একজন ক্লিনার বা ঝাড়ুদার, যিনি একটি McDonald’s রেস্টুরেন্টে কাজ করেন (সব পেশার প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে বলছি)।
এই ব্যক্তি হয়তো জানেন না, কিংবা কেয়ারও করেন না, যে একটা বার্গার কত ডিগ্রি তাপমাত্রায় রান্না করতে হয়। কিংবা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস কতক্ষণ ধরে ফ্রায়ারে রাখতে হয় যাতে সেগুলো ঠিকমতো তৈরি হয়। এগুলো তার জানারও বিষয় না, আগ্রহেরও না।
সে জানে ও মানে যা তার কাজের জন্য প্রয়োজনীয়।
সে McDonald’s-এর পুরো শাসন কাঠামোর প্রতি আত্মসমর্পণ না করলেও, নিজের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অংশটুকু সে মেনে চলে।
এই ব্যক্তিকে তুলনা করা যায় একজন মুসলিমের সঙ্গে।
অন্যদিকে, একজন মু’মিন হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি পুরো শাসন কাঠামোর যৌক্তিকতা, ভিত্তি, কারণ ইত্যাদি বুঝে ফেলেছেন।
তিনি জানেন কেন ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে ফ্রায়ারে রাখা হয়,
কেন ফ্রাই করা শেষে তেল ঝরিয়ে তারপর তাতে লবণ দেওয়া হয়,
এই সবকিছুর পেছনে থাকা নীতিমালা ও কারণসমূহ তিনি বোঝেন।
এমন ব্যক্তি শুধু আত্মসমর্পণ করেই থেমে থাকেন না, বরং সচেতনভাবে বিশ্বাস করেন, উপলব্ধি করেন, এবং বোঝেন কেন এভাবে শাসন চলে।
এবং তার চেয়েও উচ্চতর স্তরে রয়েছেন সেই ব্যক্তি,
যিনি এই নিয়মগুলোর ব্যাখ্যা দেন, অথবা নিজে কোনো কোনো নীতিমালার গঠন ও পর্যালোচনায় অংশগ্রহণ করেন—এই ব্যক্তি হচ্ছেন “মুহসিন” বা অন্তর্দৃষ্টিধারী (insight-holder)।
তিনি শুধু একজন মু’মিনের মতো বিশ্বাস করেই থেমে থাকেন না—তিনি বোঝেন এই নিয়ম-কানুন এবং কার্যপ্রণালীগুলো কীভাবে গঠিত হয়েছে, এর পেছনে কী পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, কী গবেষণা হয়েছে, কী পর্যালোচনা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, তিনি জানেন—কী ধরনের আলু বেছে নিতে হয়, কী তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়, কত ডিগ্রি তাপে কতক্ষণ ভাজতে হয়, ব্যাগ থেকে বের করে কীভাবে তেলে দিতে হয়, ইত্যাদি।
এই সমস্ত নিয়ম-কানুন বহু পরীক্ষা, পরীক্ষামূলক রান্না, গ্রাহকের প্রতিক্রিয়া যাচাই ইত্যাদির মাধ্যমে তৈরি হয়েছে।
যিনি এসবের পিছনের ঘটনা, ইতিহাস, যৌক্তিকতা—এই গভীরতাগুলো বোঝেন, তিনিই হচ্ছেন “মুহসিন”—অন্তর্দৃষ্টি লাভকারী।
এটি শাসন কাঠামোর এমন এক স্তর, যেখানে ব্যক্তি কেবল নিয়ম মানেন বা বিশ্বাস করেন না—বরং তিনি ব্যবস্থার পেছনের দর্শন ও প্রক্রিয়াটিও বোঝেন।
দ্বীনের যেকোনো অংশে কিছু ব্যক্তি বা এজেন্ট থাকেন, যাঁরা অত্যন্ত সচেতন, নিখুঁত ও বিস্তারিতভাবে শাসনের প্রতিটি দিক বাস্তবায়ন করেন—চাই সেটা আল্লাহর নির্ধারিত হোক, অথবা কোনো বিশেষ কাঠামোর (যেমন আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান) নির্ধারিত শাসন কাঠামো হোক।
আমি আশা করি, এ পর্যবেক্ষণগুলো এখন পরিষ্কার।
সুতরাং, এখন আমাদের সামনে এক নতুন ফ্রেমওয়ার্ক এসেছে—কুরআনের প্রতিটি শব্দকে বোঝার জন্য একটি শাসনকেন্দ্রিক (governance-based) দৃষ্টিভঙ্গি।
যদি আপনি শাসনের ধারণা না বোঝেন, তাহলে কুরআনের পরিভাষাগুলোর প্রকৃত অর্থও ধরা পড়বে না।
উদাহরণস্বরূপ, কেবল “মালাক” বা “মালাইকা” এই ছোট্ট শব্দেই গভীর তথ্য নিহিত রয়েছে—
যা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, আমাদের এই দুনিয়ায় ও আখিরাতে ভূমিকা—সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
এটি একটি মন-মুক্তকারী ও দৃষ্টিভঙ্গি বিস্তারকারী ধারণা—যার মাধ্যমে কুরআনের সাথে এই বিশ্বজগতের সম্পর্ক নতুনভাবে উপলব্ধি করা যায়।
আমরা অনেক সময় শুনি:
“আপনারা কুরআনের ওপর গবেষণা, পরিশ্রম, অধ্যয়নের কথা বলেন—এটা কি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ?”
হ্যাঁ, এটি অপরিহার্য—কারণ এর ব্যতীত, আমরা এই জগতে আমাদের নিজস্ব ভূমিকা ঠিকভাবে বুঝতে পারি না।
আমি আশা করি, এটি এখন স্পষ্ট হয়েছে এবং যারা আগে এটা বুঝতেন না, তাদের জন্যও এটা উপকারে এসেছে।
এবার আসি “মালাক” বা “মালাইকা”র ধারণায়:
“মালাক” বা “মালাইকা” এমন কেউ,
যিনি শাসন কাঠামোর একাধিক ক্ষেত্র পেশাগতভাবে সঠিক পথে পরিচালনা ও বাস্তবায়ন করতে পারেন—সব ক্ষেত্র না হলেও, অনেক ক্ষেত্র।
ধরা যাক আবার McDonald’s-এর উদাহরণ:
একজন কর্পোরেট কর্মী, যিনি গভর্ন্যান্স ম্যানুয়াল লিখেছেন,
তিনি বিভিন্ন কার্যপ্রণালী জানেন এবং বোঝেন।
অথবা, একজন ম্যানেজার যিনি সেই নিয়মগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করেন।
এই ব্যক্তিরাই উদাহরণ হতে পারেন “মালাক” বা **“মালাইকা”**র।
সুতরাং, “মালাইকা” কেবল “আত্মসমর্পণকারী” নন—
তাঁরা হচ্ছেন অভিজ্ঞ, দক্ষ, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন, বিশেষজ্ঞ স্তরের এজেন্ট,
যাঁরা বিশ্বাসও করেন, ব্যাখ্যাও করতে পারেন, এবং বাস্তবে সিস্টেম পরিচালনাও করতে পারেন।
এখন, যেহেতু আমরা মালাইকাʾ ধারণাটি বুঝতে পারলাম, তাহলে কি আমরা এখনো এটির অনুবাদ হিসেবে “ফেরেশতা” বা “angels” শব্দটি ব্যবহার করব?
সম্ভবত করব—এই মুহূর্তে—কারণ এর চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প এখনো নেই।
যদিও, হয়তো আমরা “Governor” শব্দটি ব্যবহার করার কথা ভাবতে পারি।
কিন্তু “Governor” শব্দটি আধুনিক ব্যবহারে এত নেগেটিভ বা নেতিবাচক ধারণা বহন করে যে আমি ব্যক্তিগতভাবে এটিকে পছন্দ করি না।
তাই, আপাতত আমরা “angels” (ফেরেশতা) শব্দটি ব্যবহার করেই যাব—যতক্ষণ না আমরা Malāykaʾ শব্দটির জন্য আরও নির্ভুল ও যথার্থ কোনো অনুবাদ তৈরি করতে পারি বা ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারি।
কিন্তু মৌলিকভাবে আমাদের বুঝতে হবে যে Malāykaʾ শব্দটি Malak শব্দের বহুবচন।
এটি এমন কাউকে বোঝায়, যে বহু ক্ষেত্রে গভীরভাবে অভিজ্ঞ এবং দক্ষ—বিশেষ করে শাসন কাঠামোর একাধিক ক্ষেত্রে।
এবং অবশ্যই, কুরআনের প্রসঙ্গে, এটি বোঝায় আল্লাহ্র নির্ধারিত শাসন কাঠামোতে পারদর্শী সত্তাদের।