ভূমিকা:
আলহামদুলিল্লাহ। আজ আমরা যে বিষয়টি আলোচনা করবো তা হলো—আনফুসের নেটওয়ার্ক। এটি কুরআনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি গূঢ় আধ্যাত্মিক ধারণা, যা মানব আত্মা, চেতনা এবং শিক্ষার প্রকৃত রূপ ব্যাখ্যা করে।
নাফস (نفس): এই আরবি শব্দটি “আত্মা,” “মন,” বা “চেতনা” বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এটি ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সত্তাকে নির্দেশ করে।
আনফুস (أنفس): “নাফস”-এর বহুবচন। প্রয়োজনে আমরা এই দুটি শব্দ একে অপরের পরিবর্তে ব্যবহার করবো।
এখানে নাফস ও রূহ (روح)-এর মধ্যে পার্থক্য বোঝা জরুরি। কুরআনের ভাষায়, রূহ হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এক জ্ঞানধারক, অর্থাৎ এক ধরণের ঐশী বার্তা বা দূত। এটি খ্রিস্টীয় চিন্তাধারায় প্রচলিত আত্মার ধারণার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। বরং রূহ হচ্ছে একটি ঈশ্বরীয় কার্যপ্রণালী।
কুরআনের ভাষায়, নাফস একটি মনস্তাত্ত্বিক গঠনবিশিষ্ট সত্তা, যার মধ্যে রয়েছে—
সচেতন স্তর (চিন্তা, সিদ্ধান্ত, মনোযোগ),
অবচেতন স্তর (স্মৃতি, প্রবৃত্তি, আবেগ)।
এই নাফস ঈশ্বরীয় নির্দেশনা গ্রহণ করতে সক্ষম—
সরাসরি অনুপ্রেরণা (মা বা mā) থেকে,
অথবা ঐশী মধ্যস্থতাকারী সত্তাদের মাধ্যমে (যাদের আমরা কখনো কখনো ফেরেশতা বলি, যদিও এই শব্দটি খ্রিস্টীয় চিন্তায় বিভ্রান্তি তৈরি করে)।
উল্লেখ্য, এই নির্দেশনা আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কখনোই আসে না।
প্রত্যেক মানুষের একটি নাফস থাকে, যা তার দেহের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে যুক্ত থাকে জাগ্রত অবস্থায়। তবে ঘুম, কোমা বা মানসিক অসুস্থতার ফলে এই সংযোগ আংশিকভাবে নিস্ক্রিয় হয়ে যায়, পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয় না।
একটি উপমা: আপনার পাড়ার টেলিফোন সংযোগ যেমন সক্রিয় না থাকলেও লাইন থাকে, তেমনি অচেতন অবস্থায় নাফসের সংযোগ বিদ্যমান থাকে, শুধু “এনার্জি” সক্রিয় থাকে না।
মানুষের জীবনের সূচনা হয় একটি জাইগোট (স্ফীত ডিম্বাণু) থেকে—যেখানে নারী ও পুরুষের বীজ একত্রিত হয়। এই জৈবিক বিন্যাসের পর একটি নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে, কুরআনের ভাষায়, নাফস সৃষ্টি হয় এবং একটি নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হয়।
এখানে কুরআনের শব্দ “خلق” (খালাকা) নির্দেশ করে, একটি সম্পূর্ণ নতুন সত্তা তৈরি হলো এবং এটি সংযুক্ত (علَق) হলো। এই সংযোগই আনফুস নেটওয়ার্কে প্রথম সংযোজন।
ফেতাস (ভ্রূণ)-এর নাফস প্রথমে তার মায়ের নাফসের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এই সংযোগ একটি “নোড” তৈরি করে। এরপর—
ভাইবোনদের সঙ্গে সংযোগ,
পিতার সঙ্গে সংযোগ,
শিক্ষক, বন্ধু, জীবনসঙ্গী—সবাই এই নেটওয়ার্কে একেকটি সংযোগ লাইন বা সম্পর্ক হিসেবে যুক্ত হয়।
প্রত্যেক সম্পর্কের শক্তি বা কার্যকারিতা নির্ভর করে মানসিক ও আধ্যাত্মিক সংযোগের গভীরতার ওপর। এই সম্পর্কগুলো শারীরিক নয়, বরং নাফসিক বা আধ্যাত্মিক।
টেলিপ্যাথি বা দূরবর্তী অনুভূতির মতো বিষয়গুলো নাফস-থেকে-নাফস যোগাযোগের ফলাফল হতে পারে। এ ধরনের তথ্য বিনিময় মস্তিষ্কের মাধ্যমে নয়, বরং আনফুস নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ঘটে।
অতএব, জ্ঞান ও স্মৃতি আসলে শরীরে নয়, নাফসে নিহিত। দেহ ও মস্তিষ্ক হলো একটি প্রকাশের উপকরণ, মূল জ্ঞান ধারক নয়।
আমাদের শরীরের কোষগুলো নিয়মিত পুনর্নির্মিত হয়—যেমন:
জিহ্বার স্বাদ কোষ প্রতি ১০ দিনে নতুন হয়,
ত্বক, যকৃত, রক্তকণিকা সবই নির্দিষ্ট সময় পর পর নতুন হয়ে যায়।
তবুও আমাদের স্মৃতি বা পছন্দ অপরিবর্তিত থাকে। এর মানে হচ্ছে স্মৃতি কোষে নয়, বরং নাফসে থাকে। এই প্রমাণ আধুনিক বিজ্ঞান দিতে ব্যর্থ।
ঘুমের মধ্যে আমরা স্বপ্ন দেখি, কিন্তু আমরা বুঝি জাগরণের পর। স্বপ্ন দেখা শরীরের নয়, বরং নাফসের অভিজ্ঞতা। জাগরণের সঙ্গে সঙ্গে সেই অভিজ্ঞতা শরীর প্রকাশ করতে সক্ষম হয়।
কুরআন অনুযায়ী:
নাফস কখনোই ধ্বংস হয় না,
“মাওত” (মৃত্যু) মানে স্থানান্তর, ধ্বংস নয়।
নাফস একবার সৃষ্টি হলে তা চিরস্থায়ীভাবে নেটওয়ার্কে যুক্ত থেকে যায়।
মানব জাতির সংখ্যা বাড়ছে মানে নাফসের সংখ্যাও বাড়ছে। তাই, নেটওয়ার্ক প্রসারিত হচ্ছে, সংকুচিত নয়। কুরআনের দৃষ্টিতে এই নেটওয়ার্ক চিরন্তন—খ্রিস্টীয় ধারণায় যেমন “সর্বনাশা মহাদিন” আসে, কুরআন তা অস্বীকার করে।
নাফসের দুটি মৌলিক দায়িত্ব রয়েছে:
নিজে শেখা ও বিকশিত হওয়া — এটাই কুরআনে সালাত,
অন্যদের শেখায় সহায়তা করা — এটি হলো যাকাত।
সালাত ও যাকাত শুধুই ধর্মীয় রীতিনীতির নাম নয়, বরং এগুলো নাফসের মৌলিক কার্যপ্রণালী।
তাই—
একজন শিক্ষক, প্রশিক্ষক, হাসপাতাল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাতা বাস্তবে অন্যান্য নাফসকে উন্নতির সুযোগ দিচ্ছেন,
পক্ষান্তরে, কারও শেখার সুযোগ কেড়ে নেওয়া (যেমন: আত্মহত্যা বা কারও জীবন অবরুদ্ধ করা) মানে তার নাফসের বিকাশ বন্ধ করা।
আমাদের দেহটি একটি ট্রেনিং মডিউল, যার মাধ্যমে নাফস নিজেকে গড়তে পারে। আমরা ৬০–৮০ বছর সময় পাই নাফসকে আত্ম-নির্মাণ করার জন্য।
আত্মহত্যাকারী ব্যক্তি বা কারও শেখার সুযোগ কেড়ে নেওয়া একজন মানুষের জীবনের ঐশ্বরিক উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেওয়া।
আমাদের অস্তিত্ব শুধুমাত্র এই দেহ নয়, বরং একটি আনফুস-নেটওয়ার্কে সংযুক্ত চেতনাসত্তা। এই দেহ আমাদের নাফসের বিকাশের একটি মাধ্যম মাত্র।
মৃত্যুর পর শরীর গুরুত্ব হারালেও নাফস থেকে যায়, এবং সে যা শিখেছে তা নিয়েই চিরন্তন নেটওয়ার্কে জীবিত থাকে।
আপনি কীভাবে নিজেকে একজন সচেতন ব্যক্তির মতো অবস্থানে স্থির রাখবেন এই NCU-তে (Nafs-Centric Universe), যখন আপনি জানেন বা অনুভব করেন যে আপনার সামনে যেসব মানুষের ছবি বা অবয়ব আছে, তারা প্রকৃতপক্ষে সেই ব্যক্তিদের আসল আত্মা (nafs) নয়?
তারা হলো সেই ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্বকারী avators। মনে রাখবেন, আমরা এটাই মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছি—NCU, অর্থাৎ এই জীবন।
আমি এটাকে simulation বলিনি, খেয়াল রাখবেন—সেদিকে যাবেন না—কারণ “simulation” শব্দটি একটু বিরক্তিকর এবং অতিব্যবহৃত।
এটা কোনো সিম্যুলেশন নয়। এটা আপনার নিজের নাফস-কেন্দ্রিক মহাবিশ্ব।
আপনি এই মহাবিশ্বে বাস্তব।
কিন্তু যাদের সঙ্গে আপনি মিথস্ক্রিয়া করেন—ভালোবাসেন, ঘৃণা করেন, যাদের জন্য কাজ করেন, যাদের নিয়োগ দেন, আপনার প্রতিবেশী, বন্ধু—এই চরিত্রগুলো কেউই সেই আসল নাফস নয় যাদের সঙ্গে আপনি সরাসরি যোগাযোগ করছেন।
আপনি তাদের একটি avator বা রূপের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন—আপনার মহাবিশ্বে।
এই ধারণাটি একেবারেই নতুন। আমার জানা মতে, কেউ এর আগে একে এভাবে ব্যাখ্যা করেননি।
আমরা যেমন জানি, simulation theory বলে যে, আমাদের ঘিরে থাকা পুরো বাস্তবতাই একটা simulation—আমরাও তার অংশ।
না। আমি তা বিশ্বাস করি না। কুরআনও তা বলে না।
আপনি আপনার ইউনিভার্সে বাস্তব।
কিন্তু আপনার ইউনিভার্সের বাকি অংশ—তাদেরকে আপনি চাইলে holographics বলতে পারেন—প্রতিনিধিত্বকারী রূপ।
কুরআন এটিকে বলে ṣūrat।
আল্লাহ আপনার NCU-তে অন্য এক nafs-এর একটি ṣūrat—একটি image—তৈরি করেন।
আর আপনি, একটি নাফস হিসেবে, যেটা দেখছেন সেই avatar এর, সেটা হলো “wajh”—অর্থাৎ একটি চেহারা, রূপ—যেটা আপনি চিনতে পারেন, এবং যেটি পরোক্ষভাবে সেই দূরের নফসকে উপস্থাপন করে।
আশা করি এটা পরিষ্কার।
তাহলে প্রশ্ন হলো: কীভাবে আমরা প্রতিষ্ঠিত থাকব?
আমরা কীভাবে এই NCU-এর বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে cynical হয়ে উঠব না?
এটা খুব কঠিন প্রশ্ন—কারণ তখন আপনি হয়তো আপনার স্ত্রীকে দেখে ভাবছেন, “উনি আসল না।”
আপনি হয়তো আপনার ছোট ছেলে-মেয়ে, প্রিয় বাগদত্তা, বা মাকে দেখে ভাবছেন, “উনি আসল না।”
কিন্তু এটাই তো আসল বার্তা নয়।
আপনার কাছে তারা বাস্তব—কারণ তারা হলো একটি জানালার মতো, যার মাধ্যমে আপনি সেই প্রকৃত নাফসকে দেখছেন।
তবে তারা “বাস্তব নন” আপনার NCU-তে, কেন?
কারণ আপনি যা করেন, তা তাদের সরাসরি প্রভাবিত করে না।
আপনি যা করেন, তা প্রভাব ফেলে আপনার মনের গঠিত প্রতিচ্ছবির উপর—যেটা আপনি তাদের সম্পর্কে ভাবেন। আর সেটাই আসল বিষয়।
আপনার মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু হলো আপনার নাফস।
আপনার ইউনিভার্স আপনার nafs কে কেন্দ্র করেই সাজানো।
এবং এটাই আল্লাহর পরীক্ষা নয়—বরং আপনি চাইলে বলতে পারেন এটি একধরনের বিকাশের ইনকিউবেটর, যেখানে আপনার নাফস সৃষ্টি হচ্ছে।
আপনার নাফস সৃষ্টি হচ্ছে এই মহাবিশ্বে।
আপনি এসব অবতারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছেন—তাদের সংখ্যা যতই হোক—কিন্তু আসল বিষয় হলো, আপনি তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করছেন।
তাদের কী হয়েছে, সেটা আসল নয়।
কারণ শেষ পর্যন্ত, আপনি কাউকে বা কিছুই প্রভাবিত করতে পারবেন না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া।
এইভাবে কেন গঠিত করা হয়েছে এটি?
১. তাদের রক্ষা করার জন্য।
২. আপনাকেও রক্ষা করার জন্য।
৩. নিশ্চিত করার জন্য যে আপনি সচেতন আচরণ করবেন, সিদ্ধান্ত নেবেন, অংশগ্রহণ করবেন—নিজেকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাবেন।
এখানে যাকাত কোথায় আসে?
যাকাত হলো আপনার দায়িত্ব, অন্যদের সাহায্য করার।
“আপনি কীভাবে এই avaterদের সাহায্য করবেন?”
আল্লাহ সেটার দেখভাল করবেন। আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করুন।
কুরআনে কি এর সমর্থন আছে?
আছে।
মুহাম্মদ ﷺ এর বর্ণনায় কি আছে?
আছে।
একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য হাদীসে ʿAbdullah ibn ʿAbbās বলেন:
“হে তরুণ, যা আল্লাহ তোমাকে আদেশ করেছেন, তার ব্যাপারে সতর্ক থেকো। তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন।
আল্লাহর ব্যাপারে সচেতন থেকো, তুমি তাঁকে তোমার পথে পাবে।”
তারপর বর্ণনাটি চালিয়ে বলেন:
“জেনে রাখুন, পুরো জাতি যদি আপনাকে উপকার করার জন্য একত্রিত হয়, তারা কিছুই করতে পারবে না—যদি না আল্লাহ আপনাকে সেই উপকার নির্ধারণ করেন।
আবার, যদি তারা ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়, তারা তাও কিছু করতে পারবে না—যদি না আল্লাহ সেটি নির্ধারণ করেন।”
এটা কী বলে?
আপনি আপনার প্রিয়জনদের জন্য ভালো করতে পারেন।
কিন্তু আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কিছু নির্ধারণ করে থাকলে, সেই নির্ধারিত বিষয়টাই ঘটবে—তাদের নিজস্ব বাস্তব NCU-তে।
এটা মানসচক্ষে কল্পনা করা কঠিন।
তাহলে সমাধান কী?
আপনি বাইরের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই NCU গুলোর স্থাপত্য দেখার চেষ্টা করবেন না।
আপনি একটি বড় টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখছেন যেখানে ১০৩টি অ্যাপার্টমেন্ট আছে। আপনি বাইরের থেকে দেখতে পারেন।
কিন্তু আপনি যদি সত্যিকারের অভিজ্ঞতা চান, তাহলে আপনাকে সেই অ্যাপার্টমেন্টের কোনো একটিতে বসবাস করতে হবে।
ব্যাস, আপনি এটুকুই করতে পারেন।
আপনি একসাথে একটি মাত্র তলায় থাকতে পারেন।
আপনি আছেন এই NCU-তে।
বাইরের দৃষ্টিভঙ্গি একটি আলাদা বোঝাপড়া দেয়—কিন্তু আপনি তো বাইরে নন।
আপনি NCU-র ভিতরেই আছেন।
এভাবেই আপনি স্থির থাকবেন।
আপনি আপনার বর্তমান দায়িত্বের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, যেমন:
“আমার একটি নফস আছে। আমাকে সালাত করতে হবে। আমাকে যাকাত দিতে হবে।”
তাদের জন্য নয়—আপনার জন্য।
মুহাম্মদ ﷺ এর একটি আশ্চর্যজনক বাণী আছে—আমি আগেও বলেছি:
“সতর্ক থাকুন। সচেতন থাকুন সেই বিষয়ের প্রতি যা আপনাকে উপকারে আনে।”
এর মানে কী?
তিনি কি আপনাকে আত্মকেন্দ্রিক হতে বলছেন?
না।
তিনি বলছেন—আপনার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
কুরআন বলে:
“ʿalaykum anfusakum” — আপনার উপর দায়িত্ব আপনার নিজের নফসের।
“lā yaḍurrukum man ḍalla idhā ihtadaytum” — কেউ যদি পথভ্রষ্ট হয়, সে আপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না, যতক্ষণ আপনি সঠিক পথে থাকেন।
এই কথাগুলো মুহাম্মদ ﷺ-ই বলেছেন।
তাহলে আমরা কী শিখছি এই বর্ণনাগুলো থেকে?
ঠিক তাই, যা আমি ব্যাখ্যা করলাম।
একটি ফায়ারওয়াল আছে—যেটা আপনার NCU-তে আপনার কাজ আর অন্য একটি NCU-তে থাকা নফসের বাস্তবতার মাঝখানে থাকে।
শুধু আল্লাহ নির্ধারণ করতে পারেন, কী পার হবে আর কী পার হবে না।
আশা করি এটা কিছুটা সহায়তা করেছে।
আপনি পুরো NCU স্থাপত্য দেখার চেষ্টা করবেন না।
না, আপনাকে সেখানে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
আপনি আছেন একটি নির্দিষ্ট NCU-তে।
সেইটাতেই মনোযোগ দিন।
“ʿalaykum anfusakum” — আপনার নিজের দায়িত্ব আপনার উপর।
এটা অত্যন্ত মুক্তিদায়ী।
কারণ কেউ যদি অত্যন্ত কঠিন পরিবেশে জন্মায়—আল্লাহ এই পরিবেশ সম্বন্ধে জানেন।
এবং সেই পরিস্থিতিগুলো হয়ে যায় দয়া ও মুক্তির বিশেষ বিবেচনা, যেটা তার জাগতিক জীবনের পথে প্রভাব ফেলে।
এটা খুবই সুন্দর।
কিন্তু অন্যদিকে, কেউ যদি সহজ, বিলাসবহুল পরিবেশে জন্মায়, তবে তার জন্য বোঝা আরও বেশি।
কেন?
কারণ তার NCU অত্যন্ত মসৃণ, কোনও বাধাবিহীন।
তার মানে—তাকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে, যেন সে নিজের প্রতি মনোযোগ ধরে রাখতে পারে।
আপনি নিজের জন্যই দায়বদ্ধ।
কুরআন-ভিত্তিক বাস্তবতার কাঠামো অনুযায়ী, প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজস্ব একটি NCU-তে (Nafs-Centric Universe) অবস্থান করে, যেখানে:
আপনি (আপনার নফস) আপনার মহাবিশ্বের পূর্ণ বাস্তব সত্তা এবং কেন্দ্রবিন্দু।
অন্যরা সেখানে থাকে অবতারস্বরূপ প্রতিনিধিত্বমূলক রূপে।
এইসব অবতার বা রূপগুলো আল্লাহর দ্বারা আপনার মহাবিশ্বে স্থাপিত — উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে।
এটি কোনো “সিমুলেশন” নয়। বরং এটি একটি অন্তর্নির্মিত বাস্তব মহাবিশ্ব, যা আপনাকে পরীক্ষা ও উন্নয়নের জন্য নির্মিত।
আপনার জীবনে যাদের সঙ্গে আপনি যোগাযোগ করেন — পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী, শত্রু — এরা প্রত্যেকে আপনার NCU-তে একটি চিত্র বা সুরত (ṣūrah) হিসেবে উপস্থিত।
কুরআনিক ধারণা: “তিনি যাকে ইচ্ছা রূপ দান করেন…”
(সূরা আলে ইমরান ৩:৬)
অর্থাৎ, আপনি অন্যদের আসল নফস-এর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করছেন না। বরং আপনি যা দেখছেন তা হলো তাঁদের চরিত্র, আচরণ ও প্রতিক্রিয়ার এক আল্লাহ-নির্ধারিত প্রকাশ, যা আপনার নফসের জন্য পাঠানো হয়েছে।
প্রশ্ন আসতে পারে:
“যদি আমার সন্তান, স্বামী/স্ত্রী, বা বন্ধু কেবল অবতার হয়, তবে কি তারা বাস্তব নয়?”
উত্তরটা সূক্ষ্ম:
তারা অবশ্যই বাস্তব নফস। তবে আপনি যা দেখছেন তা হলো আপনার জন্য নির্ধারিত তাঁদের এক রূপ।
আপনি তাঁদের মূল নফসকে প্রভাবিত করতে পারবেন না।
কিন্তু, তাঁদের এই অবতারের সাথে আপনার আচরণ, প্রতিক্রিয়া, সিদ্ধান্ত ও অনুভব—এসবের উপরেই আপনার নফসের পরীক্ষা হচ্ছে।
এই NCU-ভিত্তিক কাঠামোর মাধ্যমে আল্লাহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ হিকমত বা উদ্দেশ্য রেখেছেন:
আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা:
আপনি যেসব বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ রাখেন না, সেগুলোর জন্য আপনি দায়ী হবেন না। আপনি শুধু আপনার প্রতিক্রিয়া ও নিয়ত দ্বারা বিচারিত হবেন।
ব্যক্তিগত আত্মগঠনের সুযোগ:
অন্যদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে আপনি নিজের নফসকে উন্নয়ন করতে পারেন।
দৈব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা (Firewall):
আপনার কাজ সরাসরি অন্যদের নফসে পৌঁছায় না।
একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছায় আপনার প্রভাব অন্যের বাস্তব নফসে স্থানান্তর হতে পারে।
এই কাঠামো জানার পরেও, আমাদের জীবনকে গম্ভীরভাবে ও মনোযোগসহকারে দেখতে বলা হয়েছে। কেন?
কারণ, আপনার NCU-তে এই অবতারগুলো বাস্তব প্রতিচ্ছবি, যা আপনাকে পরীক্ষা ও শিক্ষা দেওয়ার জন্য।
আপনাকে তাঁদের সাথে সম্পূর্ণ বাস্তবতার মতোই আচরণ করতে বলা হয়েছে, কারণ এটাই আপনার নফস গঠনের পথ।
এই অবতারগুলো হলো এক একটি দ্বার, যার মাধ্যমে আপনার আত্মশুদ্ধি ও ঈমানী অভিযাত্রা সম্পন্ন হয়।
“তোমাদের উপর নিজ নিজ নফসের দায়িত্ব আছে। যারা ভ্রষ্ট হয়েছে তারা তোমাদের ক্ষতি করতে পারবে না যদি তোমরা সৎপথে থাকো।”
(সূরা আল-মায়িদা ৫:১০৫)
না। ইসলামের নৈতিক কাঠামো কখনোই স্বার্থপরতা উৎসাহিত করে না। তবে এটি দৃঢ়ভাবে বলে:
আপনার প্রথম দায়িত্ব আপনার নিজের প্রতি।
যেমন, আপনি যাকাত দিবেন—তবে তা কারও উপকারে আসবে কিনা তা আল্লাহর হাতে।
হাদীস:
“তোমার জন্য যা উপকারী, তাতে আগ্রহী হও এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও।”
(সহীহ মুসলিম)
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়:
ফলাফল নয়, বরং চেষ্টা ও নিয়তই মুখ্য।
আপনি অন্যদের NCU বা সিস্টেম বুঝতে যাবেন না। বরং, মনোযোগ দিন আপনার বর্তমান জীবনে:
ভাবুন একটি ১০০ তলার ভবন, প্রতিটি ফ্লোর একটি NCU।
আপনি শুধু একটি ফ্লোরে থাকেন। আপনার দায়িত্ব ওই ঘরেই।
আপনার কাজ:
সলাত, যাকাত, তাযকিয়াহ—সব আপনার নিজস্ব ঘরেই।
আপনার আত্মগঠন নির্ভর করে আল্লাহ যে চিত্র সামনে এনেছেন, তার সাথে আপনার আচরণে—না যে সে আসল মানুষটির কী হলো।
NCU মডেল অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠ:
কেউ যদি দারিদ্র্য বা কষ্টে জন্মায়, তার বিচার হবে তার প্রেক্ষাপটে।
কেউ যদি প্রাচুর্যে জন্মায়, তার জন্য দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ আরও কঠিন।
আল্লাহ প্রত্যেকের NCU বুঝে বিচার করবেন।
এই NCU মডেল আপনাকে মুক্ত করে সেই দুশ্চিন্তা থেকে যে আপনি অন্যকে ‘পরিবর্তন’ করতে পারছেন না।
আপনার কাজ হলো আপনার সামনের বাস্তবতা ও অবতারগুলোর প্রতি যথাযথ আচরণ করা।
আপনি কাউকে ‘সঠিক পথে ফেরানো’ বা ‘পরিবর্তন’ করতে আসেননি।
আপনি এসেছেন নিজেকে যাচাই ও গঠন করতে।
প্রশ্ন:
NCU-তে (নফস-কেন্দ্রিক মহাবিশ্বে), আমরা কীভাবে নিজের অবস্থানকে গুরুত্ব সহকারে ধরে রাখবো, যখন আমরা জানি বা উপলব্ধি করি—আমাদের সামনে যাদের দেখতে পাচ্ছি, তারা আসলে তাদের আসল নফস নয়?
উত্তর:
তারা হল তাদের প্রতিনিধিত্বকারী অবতার বা প্রতিচ্ছবি—কারণ আমাদের যে মডেলটি উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটি হলো এই জীবনটাই NCU।
আমি এটাকে কখনোই “সিম্যুলেশন” বলিনি—সেই ধারণায় যাবেন না।
“সিম্যুলেশন” শব্দটা অপ্রাসঙ্গিক ও অতিরিক্ত বোঝায় পূর্ণ।
এটি সিম্যুলেশন নয়—এটি আপনার নিজস্ব নফস-কেন্দ্রিক মহাবিশ্ব।
এই মহাবিশ্বে আপনি বাস্তব।
কিন্তু যাদের সঙ্গে আপনি সম্পর্ক স্থাপন করেন—ভালোবাসেন, ঘৃণা করেন, কাজ করেন, নিয়োগ দেন, প্রতিবেশী, বন্ধু—তাদের কেউই এই মহাবিশ্বে আসল নফস নয়।
আপনি তাদের এমন এক অবতার বা প্রতিচ্ছবির সাথে সম্পর্ক রাখছেন, যেটি আপনার NCU-তে সেই নফসের প্রতিস্থাপন।
এই ধারণাটি সম্পূর্ণ নতুন। আমার জানা মতে, কেউ এটি আগে প্রকাশ করেননি।
সিম্যুলেশন তত্ত্বে বলা হয়, আমরা যেই বাস্তবতায় বাস করছি, সেটাই পুরোপুরি কৃত্রিম—আমরাও।
না—আমার তা বিশ্বাস নয়, এবং কুরআনও তা বলেনা।
আপনি আপনার মহাবিশ্বে বাস্তব।
কিন্তু বাকিরা—তাদের আপনি যদি “হলোগ্রাফিক প্রতিনিধি” বলতে চান, বলুন—তারা হলো একটি প্রতিনিধি অবতার।
কুরআনে একে বলা হয়েছে “সুরত” (ṣūrat)—আল্লাহ এক নফসের প্রতিনিধি সুরত সৃষ্টি করেন আপনার NCU-তে।
আর আপনি, একজন নফস হিসেবে, সেই অবতারের যে অংশ দেখতে পান, সেটিকে বলা হয় “ওয়াজহ” (wajh)—যা সেই দূরবর্তী নফসের এক প্রতিনিধি রূপ।
প্রশ্ন: তাহলে আমরা কীভাবে বাস্তবতার সাথে যুক্ত থাকব?
কীভাবে আমরা আমাদের দায়িত্বকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করবো, যদি মনে হয়—”আমার স্ত্রী বা সন্তান বাস্তবে এখানে নেই”?
তখন সন্দেহ হতে পারে—”তারা কি আসলেই সত্যিকারের কেউ?”
এই জায়গাটি খুবই জটিল।
উত্তর:
তাদের আপনি বাস্তব বলে গ্রহণ করবেন—কারণ তারা হচ্ছে এক জানালার মতো, যার মাধ্যমে আপনি তাদের নফসের বাস্তবতাকে আংশিকভাবে উপলব্ধি করেন।
তাহলে তারা “বাস্তব নয়” বলছি কেন?
কারণ আপনার কোন কাজ তাদের আসল নফসকে সরাসরি প্রভাবিত করে না।
আপনার কাজ আপনার নিজস্ব উপলব্ধিকে প্রভাবিত করে—এবং সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
এই মহাবিশ্বটি আপনার নফসকে ঘিরে গঠিত।
এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরণের “ইনকিউবেটর”—আপনার নফসের বিকাশের জন্য।
আপনার নফস এই মহাবিশ্বে তৈরি হচ্ছে।
আপনি সেই অবতারগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছেন, এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আপনি কিভাবে তাদের সাথে আচরণ করছেন—not তারা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা উপকৃত হচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আপনি কারো উপকার বা অপকার করতে পারবেন না।
এই গঠন কেন এমন?
১. তাদেরকে সুরক্ষিত রাখার জন্য।
২. আপনাকেও সুরক্ষিত রাখার জন্য।
৩. এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আপনাকে নৈতিকভাবে পরীক্ষা ও বিকাশের সুযোগ দেওয়ার জন্য।
তাহলে যাকাত কোথায় আসে?
যাকাত হচ্ছে আপনার দায়িত্ব—অন্যদের সাহায্য করা।
আপনি ভাবতে পারেন: “আমি কি এই অবতারদের সাহায্য করতে পারবো?”
আল্লাহ সেই দিকটা দেখবেন। আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করুন।
কুরআন ও হাদিসে কি এর প্রমাণ আছে?
হ্যাঁ, আছে।
একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাদিসে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন—
“হে যুবক, আল্লাহ যা তোমাকে আদেশ করেছেন, তা রক্ষা করো, তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন… জেনে রাখো, পুরো জাতি একত্রিত হয়ে যদি তোমার উপকার করতে চায়, তারা পারবে না, যতক্ষণ না আল্লাহ তা নির্ধারণ করেন।
আর যদি তারা ক্ষতি করতে চায়, তাও হবে না—যতক্ষণ না আল্লাহ অনুমতি দেন।”
এর মানে কী?
আপনি আপনার প্রিয়জনদের ভালো করতে পারেন, কিন্তু আল্লাহ যদি তাদের জন্য অন্য কিছু নির্ধারণ করেন—সেটাই বাস্তব হবে।
তাদের NCU-তে সেটাই কার্যকর হবে।
তাহলে সমাধান কী?
বহিরাগত দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিন।
একটা বড় টাওয়ারকে বাইরে থেকে দেখা যায়, কিন্তু আপনি সেটার ভেতরে বাস না করলে সেটার অভিজ্ঞতা পাবেন না।
আপনি সেই টাওয়ারের একটি ফ্লোরে অবস্থান করছেন—এটাই আপনার NCU।
আপনি এখানে আছেন।
এই অবস্থানেই নিজের কাজে মনোযোগ দিন।
“ʿalaykum anfusakum” — তোমাদের উপর তোমাদের নিজ নিজ নফসের দায়িত্ব।
এটি অত্যন্ত মুক্তিদানকারী একটি উপলব্ধি।
কারণ কেউ যদি কঠিন পরিস্থিতিতে জন্মায়—আল্লাহ তা জানেন।
এবং সেই পরিস্থিতিগুলো তার মুক্তির জন্য বিবেচ্য হতে পারে।
আবার কেউ যদি বিলাসবহুল পরিবেশে জন্মায়—তবে তার জন্য দায়িত্ব অনেক বড়।
কেন?
কারণ তার NCU এতটাই বাধাহীন, এত সহজ—তাকে অনেক বেশি সংযমী হতে হবে, আত্ম-সচেতন থাকতে হবে।
শেষ কথা:
আপনি দায়িত্বশীল—আপনার নিজের নফসের জন্য।
প্রশ্ন:
আমার প্রশ্নটি NCU (Nafs-Centric Universe) ধারণার সাথে মালায়িকাদের ভূমিকার সম্পর্ক নিয়ে। বিশেষ করে pairing বা যুগল বিন্যাসের সঙ্গে মালায়িকারা কীভাবে সম্পৃক্ত?
আর মূল প্রশ্ন হলো—আমরা যখন কুরআনের তাফসির করি, তখন কওম, উম্মাহ, আজমায়ন ইত্যাদি বহুবচন শব্দগুলোকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব?
এগুলোকে NCU প্রেক্ষাপটে কীভাবে বোঝা যায়?
কুরআনের অনন্যতা এখানেই যে, এটি একসাথে বহু শ্রোতাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে। এটা মানুষের ভাষণের চেয়ে অনেক উচ্চস্তরের। সাধারণত মানুষ একটি শ্রোতাদলকে একবারে উদ্দেশ্য করে, কিন্তু কুরআন:
মালায়িকাকে—মুল্ক (শাসনব্যবস্থা) সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা দেয়,
আবার প্রতিটি নফস-কে—তার NCU-তে করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দেয়।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে কওম বলতে বোঝানো হচ্ছে—NCU-তে আমার চারপাশের আমার ‘জাতি’ বা ‘মানুষ’, কিন্তু তারা আসলে কে?
তারা হল অ্যাভাটার—একটি দৃষ্টিনির্ভর উপস্থিতি, আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাকে শেখানোর জন্য আমার NCU-তে স্থাপন করা হয়েছে।
তারা ‘বাস্তব’ নফস নয়। বরং আমার জন্য নির্ধারিত প্রক্রিয়ার অংশ মাত্র।
উদাহরণস্বরূপ, ইব্রাহিম যখন তার কওম-এর সঙ্গে কথা বলছেন—সে কওমটি ছিল ইব্রাহিম-এর NCU-তে স্থাপিত অ্যাভাটারসমূহ।
তাদের স্থাপন করেছিল কে? আল্লাহ।
আর এই NCU-র শাসনব্যবস্থা, মুল্ক এবং আমর (আদেশ) বাস্তবায়নে কি মালায়িকারা অংশ নেন?
হ্যাঁ, তাঁরা নেন।
মালায়িকা হচ্ছে এই NCU-র রব—পরিচালক বা তত্ত্বাবধায়ক। এই NCU শুধুমাত্র নফসের জন্য প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র নয়,
বরং নিম্নস্তরের মালায়িকাদের জন্যও একধরনের ট্রেনিং ফেজ।
প্রথমত, NCU এক নবজাত নফসের জন্য ইনকিউবেটর বা বিকাশ কেন্দ্র।
কিন্তু পাশাপাশি এটি মালায়িকাদেরও প্রস্তুত করে উচ্চস্তরের দায়িত্বের জন্য।
আল্লাহ যত মানুষের জন্য NCU তৈরি করেন, ঠিক তত/তার বেশি মালায়িকা নিযুক্ত করেন—এটা প্রয়োজনীয়তার কারণে নয়,
বরং তাঁদের প্রশিক্ষণ ও উত্তরণের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে:
নিম্নস্তরের মালায়িকার সংখ্যা বাড়ে,
তাদের তদারকি, ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বের স্তর বাড়ে,
এক ধরণের ঐশী হায়ারার্কি (divine hierarchy) গড়ে ওঠে।
আমরা যখন এই পুরো কাঠামোটি দেখি, তখন অনেক সময় নিজেকে খুব ছোট মনে হয়।
কিন্তু আমাদের দৃষ্টিকোণ প্রসারিত করতে হবে—আমার চারপাশে যাদের দেখি, তারা মূলত অ্যাপারিশন—ছায়াময় উপস্থিতি।
তারা বাস্তব নয় সেই অর্থে, যেমন আমি নিজেকে অনুভব করি।
তারা একটা প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার অংশ, যাতে করে আমি নিজেকে চিনতে পারি, পরীক্ষা দিতে পারি।
এই প্রক্রিয়ায় মালায়িকারাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা আমাদের জন্য noble visitors—আল্লাহ প্রেরিত সহায়ক।
সূরা ফাতিহা-র এই দুটি শব্দ:
الرحمن الرحيم
(আর-রাহমান, আর-রাহিম)
সাধারণভাবে অনূদিত হয় “পরম করুণাময়, অতি দয়ালু”—কিন্তু এর অর্থ অনেক গভীর।
আর-রাহমান—যিনি বহু ইনকিউবেটর বা রহমতপূর্ণ ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করেছেন—এগুলোই NCU।
আর-রাহিম—যিনি সেই ইনকিউবেটরে মালায়িকাদের প্রেরণ করেন, যারা ‘নোবল ভিজিটর’ হিসেবে কাজ করেন।
এই দুটি নাম একত্রে তরবিয়াহ ও সহায়তা-র পূর্ণতা প্রকাশ করে, শুধু “মার্সি” নয়।
إياك نعبد – আমাদের যাত্রায় আমরা শুধুমাত্র আপনাকেই অন্বেষণ করি
وإياك نستعين – এবং শুধুমাত্র আপনাকেই আমরা (জ্ঞান বা পথনির্দেশের) উৎস হিসেবে গ্রহণ করি!
প্রথম বাক্য—নফস বলছে।
দ্বিতীয় বাক্যে—মালায়িকা-রাও যুক্ত হচ্ছে, কারণ এই দু’জন মিলে একই NCU-র অভ্যন্তরে।
এরপর:
اهدنا الصراط المستقيم –
আত্ম-সংশোধনের পদ্ধতির দিকে আমাদেরকে পথ দেখান
এখানে বহুবচন কেন?
কারণ এই দোয়াতে নফস ও মালায়িকা উভয়ই অংশ নিচ্ছে।
মালায়িকা কি পথনির্দেশনা চায়? হ্যাঁ,
কিন্তু তারা তা পায় মানব নফসের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কে।
এই প্রশিক্ষণ পারস্পরিক, reciprocative।
কুরআনে দারাজাত বা স্তরের কথা বলা হয়েছে।
মালায়িকারা এই স্তর ধরে উন্নতি করে।
তারা আদেশপ্রাপ্ত (yuqmarūn) হয় এবং সেই অনুযায়ী কর্ম (yafʿalūn) করে।
يُوقَمَرُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
“They do what they are commanded.” (66:6)
তারা আমাদের NCU-র রব হিসেবে কাজ করে।
আল্লাহ অবশ্যই সকল কিছুর চূড়ান্ত রব,
কিন্তু মাঝপথে মধ্যবর্তী কর্তৃত্ব ও প্রশিক্ষণ কাঠামো তৈরি করেন।
আপনি যদি ভালোবাসার কথা বলতে চান, তাহলে এই মহাবিশ্বই আল্লাহর ভালোবাসা।
এই NCU, এই মালায়িকা, এই দৃষ্টিনির্মিত কাঠামো—সবই একটি মাত্র নফসকে সাহায্য করার জন্য সৃষ্টি, এটাই ভালোবাসা।
এটাই আর-রাহমান ও আর-রাহিম নামের বাস্তব অর্থ।
প্রশ্ন ছিল:
“যদি আমি আমার বিচ্ছিন্ন NCU-তে (Nafs-Centric Universe) অন্য কোনো আত্মার (anfuṣ) উপর প্রভাব ফেলতে না পারি, তাহলে আমি কীভাবে Nafs-কে শেখা থেকে বিরত রাখতে পারি?”
উত্তর:
প্রশ্নটি ভালো, কিন্তু এর মধ্যে একটি ভুল অনুমান আছে।
প্রথমত, যদি আপনি সত্যিই অন্যদের উপর প্রভাব ফেলতে না পারেন, তাহলে সেটা এ জন্য যে, আপনার NCU-তে কোনো ‘অন্য anfuṣ’ আদতেই নেই। আপনার দৃষ্টিতে যে অবতারগুলো (avatars) উপস্থিত, তারা শুধু চেহারা মাত্র—সচেতন সত্তা নয়। তারা দেখায় যেন জীবিত, যেন বাস্তব, কিন্তু এর মানে এই নয় যে তাদের পিছনে আসল কোনো nafs বিদ্যমান রয়েছে।
এই প্রশ্নের ভুল ধরনা হলো:
প্রশ্নকারী ধরে নিচ্ছে যে প্রতিটি অবতার একটি জীবন্ত, দুই-দিক থেকে সংযুক্ত nafs দ্বারা সমর্থিত।
কিন্তু এটি সত্য নয়।
সত্যটা হলো—সামনে যা আপনি দেখছেন, তা কেবল একটি আল্লাহর তৈরি প্রতিচ্ছবি বা প্রতিরূপ (apparition), যেটা কেবল আপনার জন্য উপস্থাপিত হয়েছে—আপনার প্রতিক্রিয়া যাচাইয়ের জন্য।
তাহলে আপনি কি এই অবতারগুলোকে প্রভাবিত করতে পারবেন?
না, পারবেন না।
আপনি মনে করতে পারেন যে আপনি প্রভাব ফেলেছেন, কিন্তু আসলে আল্লাহ যা চান, সেটাই আপনি বিশ্বাস করবেন—আপনি হয়তো ভাববেন আপনি প্রভাব ফেলেছেন, বা ভাববেন আপনি পারেননি। এটা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
তাহলে আপনি কেন কিছু করবেন?
কারণ আপনার উচিত প্রতিক্রিয়া দেখানো সেই বাস্তবতার প্রতি, যেটা আল্লাহ আপনার সামনে উপস্থাপন করেছেন আপনারই উন্নতির জন্য।
তাই বিষয়টা হলো:
আপনি শুধু নিজেকে প্রভাবিত করতে পারবেন।
অন্য সবকিছু হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি প্রতিক্রিয়া—সেটা হোক ইতিবাচক বা নেতিবাচক।
এই প্রতিক্রিয়াগুলো আপনি নির্ধারণ করেন না—আল্লাহ নির্ধারণ করেন, এবং এগুলো শেষপর্যন্ত আপনারই কল্যাণের জন্য।
সারসংক্ষেপে:
আপনার দায়িত্ব হলো নিজের উপর কাজ করা। আপনার চারপাশে যা কিছু ঘটে তা হলো আল্লাহর পরীক্ষার উপকরণ, যেগুলোর মাধ্যমে আপনার nafs গঠন ও পরিশুদ্ধ হয়। বাস্তবতা কেবল একটি আল্লাহ-নির্দেশিত প্রতিচ্ছবি—প্রতিক্রিয়া মূলক, উদ্দেশ্যমূলক, কিন্তু সরাসরি আপনার দ্বারা প্রভাবিত নয়।